আজকের দৈনিক | আব্দুর রউফ
প্রকাশিত: মার্চ ৩, ২০২৪, ০৯:৪০ পিএম
মাঘে শুরু, ফাল্গুণে শেষ। ফেব্রুয়ারি পেরিয়ে মার্চের ২। মনে হয় যেন এইতো সেদিন, কেটে গেলো বইমেলার ৩১দিন। আবেগ-উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসায়, বইপ্রেমী মানুষের সরব উপস্থিতিতে প্রাণচঞ্চল ছিল অমর একুশে বইমেলা প্রাঙ্গণ। বাংলা ও বাঙালির প্রাণের এই মেলার শেষ দিনে মেলাপ্রাঙ্গণে ছিল মানুষের পদচারণা।
তবে ভাষার মাসের সঙ্গে মেলার যে আবেগ, মার্চে এসে তার সঙ্গে যেন মন মেলেনি অনেকের। তাই ছুটির দিনেও বেশ নিরালা পরিবেশ। দুদিন মেয়াদ বাড়লেও, শেষ দিন হিসেবে সাপ্তাহিক এ ছুটির দিনে ছিল না তেমন বাড়তি চাপ। ফলে প্রকাশকদের হয়নি প্রত্যাশিত বেচাকেনা। দিনের প্রথম ভাগে লোকসমাগম ছিল নগণ্য। অপরাহ্ণে তা বাড়লেও ফেব্রুয়ারির ছুটির দিনগুলোতে যেমন আবহ ছিল, তেমন পরিবেশ ফেরেনি এই বাড়তি দিনে। তাই বিক্রিও হয়েছে অন্যান্য দিনের মতো স্বাভাবিক।
শেষদিন শনিবার থাকায় মেলা শুরু হয় সকাল ১১টায়, চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। সরকারি ছুটির দিনের পাশাপাশি মেট্রোরেলের সুফল মিললেও, মনে হয়েছিলো মেলার বর্ধিত সময়সূচি নিয়ে অনেকেই অজানা। তাই বেলা বাড়ার পরও ছিল অন্য দিনগুলোর মতো স্বাভাবিকতা। অন্যান্য বছরের শেষ দিনের ন্যায় ছিল না লোকারণ্য। যারা এসেছিলেন তাঁদের সকলের মাঝে আনন্দ-উৎফুল্লতা থাকলেও একইসাথে ছিল বিষাদ আর বিদায়ের সুর। এরই মাঝে নতুন ঠিকানায়, অপেক্ষায় রেখে বিদায় নিল প্রাণের মেলা। আজ থেকে বইপ্রেমীদের পদচারণে মুখরিত হবে না এখানকার বিস্তীর্ণ প্রান্তর।
মেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী এবারের বইমেলায় প্রায় ৬০ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। গতবার ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিলো। গতবারের তুলনায় এবার ১৩ কোটি টাকার বই বেশি বিক্রি হয়েছে। এই বইমেলায় বাংলা একাডেমি ১ কোটি ৩৬ লাখ টাকার বই বিক্রি করে। গতবারের তুলনায় এবার বাংলা একাডেমির বিক্রি বেড়েছে ১২ লাখ টাকা।
শেষ দিনে বই না কিনে ফিরেছেন এমন লোকের সংখ্যা হাতেগোনা। প্রায় প্রত্যেকের হাতেই দেখা গেছে কম বেশি বইয়ের ব্যাগ। গত এক মাস ধরে অনুষ্ঠিত বইমেলায় নতুন প্রকাশের শীর্ষে ছিল কবিতার বই। অন্যদিকে, উপন্যাসও বেরিয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক। অন্বেষা প্রকাশনীর প্রকাশক শাহাদাত হোসেন বলেন, মেলার শুরুতে ভেবেছিলাম কাগজের বাড়তি দামে বইয়ের বেশি দামের কারণে পাঠক কম কিনবে। কিন্তু বাস্তব চিত্র একেবারেরই ভিন্ন। বইপ্রেমী বাঙালি মেলায় এসে বই কিনেই ঘরে ফিরেছে। গতকাল শেষ দিনে নতুন বই এসেছে ১৪৯টি। ৩১দিনে মোট নতুন বই এসেছে ৩ হাজার ৭৫১টি। বাংলা একাডেমিসহ সব প্রতিষ্ঠানের বই ২৫ শতাংশ কমিশনে বিক্রি হয়েছে।
মেলায় স্থাপন করা আর্চওয়ের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, এবার দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৫৯ লক্ষাধিক। যা গতবারের তুলনায় বেশ কম। সুস্পষ্টভাবে নীতিমালা লঙ্ঘনের কারণে মোট ২০টি স্টল-প্যাভিলিয়নকে শোকজ করা হয়।
এদিকে মেলায় পাঠক-দর্শনার্থী-বিক্রয়কর্মীসহ সংশ্লিষ্ট সবার সুবিধার জন্য ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউটের পাশে খাবারের স্টলের জন্য বরাদ্দ দিয়েছিলো কর্তৃপক্ষ। সেখানে মোট ২১টি স্টল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে ফুচকা, আইসক্রিম ও কফি শপ। মেলা শেষে বরাদ্দকৃত স্টলের এসব ব্যবসায়ীরা কেমন ব্যবসা করলেন- জানতে চাইলে কেউ কেউ বলেন, মাসব্যাপী মেলায় স্টলগুলোতে দৈনিক গড়ে বিক্রি হয়েছে ৩০-৪০ হাজার টাকা। তবে এই বিক্রি সন্তোষজনক না বলে দাবি করেছেন তারা। লাভ হওয়া নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন কেউ কেউ।
অন্যদিকে আইসক্রিম বিক্রেতারা জানান, মেলায় দোকান বেশি, সেই আলোকে বিক্রি ভালোই। জায়গাভেদে বিক্রির পার্থক্য রয়েছে বলেও জানান তারা। কারও দৈনিক বিক্রি ১০-১২ হাজার টাকা, কারও বিক্রি ৫-৬ হাজার টাকা।
বইমেলার শেষদিন মেলায় ঘুরে দেখা যায়, বর্ধিত এই সময়ে ছুটির দিন হলেও খাবারের দোকানগুলোতে নেই তেমন লোকসমাগম। ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাবারের দোকান মেলার একেবারে শেষ প্রান্তে বরাদ্দ দেওয়ায় ও সবগুলো দোকান একসঙ্গে দেওয়ায় বিক্রি কম হয়েছে। অনেকে ফুড কোর্টের বিষয়ে জানেন না বলেও মনে করেন তারা।
সমাপনী অনুষ্ঠান
বিকেল ৫টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা ভাষণ প্রদান করেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৪’-এর সদস্য-সচিব ডা. কে এম মুজাহিদুল ইসলামের লিখিত প্রতিবেদন তাঁর পক্ষে পাঠ করেন একাডেমির উপপরিচালক ড. সাহেদ মন্তাজ। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী। সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী বেগম নাহিদ ইজাহার খান এমপি, বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব খলিল আহমদ। বক্তব্য প্রদান করেন সহযোগী প্রতিষ্ঠান বিকাশ লিমিটেড-এর সিএমও মীর নওবত আলী। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন। অনুষ্ঠানে সম্প্রতি বেইলি রোডে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘এবার ছিল অধিবর্ষের বইমেলা। নির্ধারিত ২৯ দিনের সঙ্গে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সদয় নির্দেশনায় অতিরিক্ত ০২ দিন যুক্ত হয়ে ৩১ দিনের দীর্ঘ বইমেলার আজ (গতকাল) শেষ দিন। ২০২৪-এর বইমেলা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় ছিল বিস্তৃত, ব্যাপক ও বর্ণাঢ্য। শীতে শুরু হয়ে বইমেলা স্পর্শ করেছে বসন্ত-বাতাস। একুশের রক্তপলাশের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মার্চের চেতনার রং।‘
গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪
বইমেলার এ সমাপনী অনুষ্ঠানে, ২০২৩ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য কথাপ্রকাশ-কে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হয়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে মনজুর আহমদ রচিত ‘একুশ শতকে বাংলাদেশ : শিক্ষার রূপান্তর’ গ্রন্থের জন্য প্রথমা প্রকাশন, মঈন আহমেদ রচিত ‘যাত্রাতিহাস : বাংলার যাত্রাশিল্পের আদিঅন্ত’ গ্রন্থের জন্য ঐতিহ্য এবং আলমগীর সাত্তার রচিত ‘কিলো ফ্লাইট’ প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকস-কে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪ প্রদান করা হয়। ২০২৩ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খি-কে রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৪ প্রদান করা হয়।
২০২৪ সালের অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্যপ্রকাশ (প্যাভিলিয়ন), নিমফিয়া পাবলিকেশন (২-৪ ইউনিট) এবং বেঙ্গল বুকস (১ ইউনিট)-কে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৪ প্রদান করা হয়।
আ.দৈ/এআর
আপনার মতামত লিখুন :