শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
Ajker Dainik

টেলিভিশন: একটি নিত্যব্যবহার্য "ইডিয়ট বক্স"

আজকের দৈনিক | খ. আলম

প্রকাশিত: মার্চ ২৯, ২০২৪, ১০:৩৭ পিএম

টেলিভিশন: একটি নিত্যব্যবহার্য

টেলিভিশন একটি অত্যন্ত শিক্ষামূলক মাধ্যম কারণ কেউ যখন আমার পাশে টিভি দেখতে বসে, আমি তখন অন্য রুমে গিয়ে পড়তে বসি। - গ্রুচো মার্কস (১৮৯০- ১৯৭৭), জনপ্রিয় মার্কিন কৌতুক অভিনেতা


জনশ্রুতি আছে, পৃথিবীর সব জ্ঞানীরা নাকি একইরকম ভাবেন, হয়তো তাই অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল তাঁর বাসায় টিভি রাখেন না বলে প্রচার আছে এবং কাজে কাজেই আর পাঁচ জনের চাইতে বেশি সময় পড়তে বসার ফুসরত পেয়ে তিনি আমাদের সমাজের একজন জ্ঞানী ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃত! কিন্তু নিজেকে কার্ল মার্কসের একজন বিশুদ্ধ অনুসারী হিসেবে আত্মপ্রসাদে কাল-কাটালেও তাঁর পরিবর্তে গ্রুচো মার্কসকে উদ্ধৃত করে প্রকারান্ডরে গুরুর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করছি এই ভরসায় যে, মৃত ব্যক্তির গুরু দক্ষিণা চাওয়ার মুরোদ নেই। অবশ্য আমাকে খানিকটা উদ্ধার করতে পারেন ব্রিটিশ কবি ও সাহিত্যিক রোল্ড ডাল (১৯১৬-১৯৯০)। গ্রুচো মার্কস এবং আমি - আমাদের যৌথ স্বরে সুর মিলিয়ে তিনিও যখন বলেন, "So, please, oh please, we beg, we pray, go throw your TV set away, and in its place you can install, a lovely bookcase on the wall."


ভারতবর্ষে সংবাদপত্র প্রকাশের প্রথম দিককার সবগুলো উদ্যোগই নিয়েছিলেন সঙ্গত কারণেই ইংরেজ বণিকরা। উদাহরণ হিসেবে উইলিয়াম বোল্টস (১৭৬৮) এবং অগাস্টাস হিকিকে (১৭৮০) টেনে (হিঁচড়ে) আনা যায়। উল্লেখিত ব্যবসায়ীদ্বয় (লবণ ও অন্যান্য) বাহানা হিসেবে খবরের কাগজ না থাকার ফলে ব্যবসার কী কী ক্ষতি হচ্ছে কিংবা খবরের কাগজ থাকলে ব্যবসার আরও কী কী লাভালাভ হতো তার ফিরিস্তি দিয়ে তা প্রকাশের যৌক্তিকতাকে তুলে ধরেন বারংবার। ফলে ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে খবরের কাগজের সাথে বাণিজ্য বিস্তারের একটি ঐতিহাসিক হরি-হর সম্পর্কের হদিস পাই আদি উদ্যোক্তাদের বয়ান থেকেই। সময়টা ছিল তখন অনেকটাই চাঁছাছোলা তাই হালের সংস্কৃতিসেবীদের মতো কায়দা করে কথা কইতে (যেমন ধরন, বদলে দাও-বদলে নাও কিংবা সত্য প্রকাশের দূরস্ত দুঃসাহস ইত্যাদি) পারেননি তখনকার পত্রিকাওয়ালারা। সোজা কথা সোজা-সাপ্টাভাবেই বলেছেন তারা। প্রধানত পণ্য বিপণন-বার্তা হিসেবে তাদের সংবাদপত্র প্রকাশ করাটা খুব জরুরি ছিল। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসন পরবর্তীতে বিষয়টিকে একটি তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করান তাঁর ‘মুদ্রণ-পুঁজিবাদ' ধারণাটির মধ্য দিয়ে। অ্যান্ডারসনের বরাতে আমরা জানতে পারি, পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থার মধ্যে মুদ্রণ-প্রযুক্তি বিশেষত সংবাদপত্র কীভাবে একটি ‘কল্পিত- সম্প্রদায়' তৈরি করে আধুনিক জাতীয়তাবাদ এবং রাষ্ট্রকাঠামোর পক্ষে ওকালতি করে যাচ্ছে। অবশ্য কানাডিয়ান তাত্ত্বিক হ্যারল্ড ইনিস তারও খানিকটা আগে সভ্যতার বিবর্তন ও বিচলনে মুদ্রণমাধ্যমের ঐতিহাসিক ভূমিকার তাৎপর্য উপলব্ধি করে 'যান্ত্রিক-জাতীয়তাবাদ' ধারণাটি বাজারজাত করে যান।


কিন্তু শতক ঘুরতে-না-ঘুরতেই মুদ্রণমাধ্যমের রাম-রাজত্বে রাবণের ভূমিকায় চলে আসে নয়া তথ্য-প্রযুক্তি। যেটি পরবর্তী সময়ে তথ্য-বিপ্লবের অভিধাপ্রাপ্ত হয়। আর কারও কারও কাছে এ বিপ্লবের অভিঘাত এতটাই তুঙ্গস্পর্শী যে, পৃথিবীর অন্য কোনো পূর্বতন বিপ্লবকে এ কাতারে ঠাঁই দিতেও নারাজ তাঁরা। এই নিমরাজি-ওয়ালাদের মধ্যে জোসেফ এল ডাইওনি অন্যতম। তিনি মনে করেন, শিল্পবিপব দুই শতকে যে পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে, তথ্য-বিপ্লব গত দু'দশকেই তা সম্ভব করেছে। ফলে অর্থনীতির অমোঘ নিয়মে পুঁজি-প্রযুক্তি ত্বরিত বনে যায় মাসতুতো ভ্রাতা। নিন্দুক-মহল অবশ্য বসে থাকেনি। পুঁজি-প্রযুক্তি'র এ ত্বরিত মিতালিকে 'যান্ত্রিক-পুঁজিবাদ' উপনামে ডাকতে কাল-বিলম্ব করেননি তাঁরা। ডগলাস কেলনার (১৯৪৩) আবার এককাঠি সরেস! তিনি আরও একধাপ এগিয়ে যান্ত্রিক-পুঁজিবাদী এ যুগে টেলিভিশনের কেরামতিতে মুগ্ধ হয়ে তার ওপর ইমামতির আলখাল্লা চাপিয়ে দিয়েছেন। তাঁর ভাষায় টেলিভিশন হচ্ছে, 'ভ্যানগার্ড অব টেকনো-ক্যাপিটালিজম'।


নব্বই পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী টিভি চ্যানেলের রমরমা প্রসারের শতেক কারণ আছে নিশ্চয়ই। কিন্তু একটি কারণকে ওয়াকিবহালদের কেউ অবজ্ঞা করতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। স্পষ্টতই, 'কাছাখোলা অর্থনীতি' কিংবা ভদ্রস্থ ভাষায় 'মুক্তবাজার অর্থনীতি'কেই ইঙ্গিত করছি। ডেভিড পেজ ও উইলিয়াম ক্রাওলিসহ অন্যান্য তাত্ত্বিকরা অবশ্য আরও কয়েকটি কারণকেও এ ক্ষেত্রে বিশেষ মর্যাদা দিতে কার্পণ্য দেখাননি। সোভিয়েত ইউনিয়নকেন্দ্রিক সমাজতান্ত্রিক শিবিরের ভাঙ্গন, তথ্য-প্রযুক্তির শনৈ শনৈ উন্নতি, দ্রুত-বর্ধমান আন্তর্জাতিক পুঁজির পুঞ্জীভবন ইত্যাদি কারণসমূহও বিশেষভাবে উঠে এসেছে তাঁদের ব্যাখ্যা-বয়ানে। বাদ-বাকি বিশ্বের মতো একই গ্রহের বাসিন্দা হিসেবে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটও প্রায় অভিন্ন। কেবল যুক্ত হয়েছে কয়েকটি স্থানিক কারণ। নব্বই'র পরে নব্য-উদারনৈতিক অর্থনীতির ছত্রছায়ায় বিশ্বব্যাপী গড়ে ওঠা কথিত গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের মধ্যে বাংলাদেশ একটি। আর এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত/সুশীল সমাজ গণতন্ত্রকে খুঁজতে থাকে বাক-প্রকাশের স্বাধীনতা নামক সোনার হরিণ, আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে সোনার বাক্সের মধ্যে। বলে রাখা ভালো, বাক- স্বাধীনতাকামী এই বকধার্মিকদের কাছে 'বাক-স্বাধীনতা' মানে প্রচল স্রোতের বাঁকে নিজ শ্রেণিস্বার্থের অনূকূলে কথা কইবার সুযোগ-সুবিধে। বিদ্যমান ক্ষমতা-কাঠামোকে খোল-নলচে পাল্টে দিতে পারে এমন গণমুখী ও গণতান্ত্রিক (প্রকৃত অর্থে) কোন উদ্যোগকে ওই সব ‘কথা-কইবার-স্বাধীনতাকামী' কিংবা গণ-নামধারী গণমাধ্যমের পক্ষেও যে শ্রেণী পক্ষপাতিত্বের জায়গা থেকে এস্তেমাল করা সম্ভব নয় তার উদাহরণও আছে ভুরি ভুরি। যাক সে কথা। বলছিলাম, বাক-প্রকাশের স্বাধীনতা ধারণাটি এসেছে মানব- প্রগতির একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে, সপ্তদশ শতকে ইউরোপীয় নবজাগরণের হাত ধরে সামড়-দাসত্ব ভেঙ্গে ব্যক্তিকে শৃঙ্খল-মুক্ত ও স্বাধীন করার প্রত্যয় থেকে। কিন্তু উদারনৈতিক এই ধারণাটি নব্য-উদারনৈতিক কালে এসে প্রভুর পরিবর্তে পুঁজির দাসে পরিণত হয়েছে। ফলে অপরাপর গণমাধ্যমের মতোই টেলিভিশন গণমানুষের পরিবর্তে পুঁজির প্রচারমাধ্যমে পরিণত হয়েছে যাকে ডগলাস কেলনার বলছেন, 'যান্ত্রিক- পুঁজিবাদের ইমাম'।


আমরা জানি, পণ্য প্রসার কিংবা প্রচারে প্রয়োজন দক্ষ প্রচারমাধ্যম আর প্রচারমাধ্যম নির্মিত তারকা। নিঃসন্দেহে 'দৃশ্য-শতি' মাধ্যম হিসেবে টেলিভিশন কাজটি করতে পারে অন্য যেকোনো মাধ্যমের চাইতে তুলনামূলকভাবে বেশি বিশ্বাসযোগ্য ও প্রাণবন্তÍ কলা-কৌশলে। আর দৃশ্যমাধ্যম হিসেবে এটি তৃণমূলের নিরক্ষর ভোক্তাটিকেও স্পর্শ করতে পারে সমানতালে, নানান কায়দা-কানুনে। ভোক্তা/ব্যবহারকারীর আর্থিক অংশগ্রহণের জায়গা থেকে সংবাদপত্রের সাথে টেলিভিশনের রয়েছে একটি মৌলিক তফাৎ। অর্থনৈতিকভাবে টেলিভিশন ষোল-আনাই নির্ভর করে কমার্শিয়ালস অর্থাৎ কর্পোরেট সেক্টরের ওপর, অন্যদিকে সংবাদপত্র অংশত নির্ভর করে ব্যবহারকারীর ওপর। তাই টেলিভিশনের সাথে দর্শকের সম্পর্ক পরোক্ষ, বিপরীতে কর্পোরেট সেক্টরের সাথে প্রত্যক্ষ। ফলে দর্শকের কাছে টিভির জবাবদিহিতার বিষয়টি বিজ্ঞাপনদাতা হয়ে এক ধাপ ঘুরে আসতে হয়, যেটি তুলনামূলকভাবে সংবাদপত্রের সাথে খানিকটা সরাসরি। টেলিভিশনের সংশ্রব দর্শকদের সাথে কেবল ততোটাই, বিজ্ঞাপনদাতাদের আকৃষ্ট করতে যতোটা দর্শক-প্রিয়তার জায়গায় নিজেকে প্রতিষ্ঠা কিংবা প্রমাণ করা যায়। সংবাদপত্রের সাথে টিভির এ পার্থক্যটা সূক্ষ্ম কিন্তু তুচ্ছ নয়।


ফলে নব্বই'র গোড়া থেকে আমরা ‘গণতন্ত্র-গণমাধ্যম' যুগলকে ব্যাপক মাত্রায় ব্র্যাকেটবন্দী অবস্থায় আবিষ্কার করতে শুরু করি। সর্ব-সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অর্ধ-শতাব্দী পূর্তি উদযাপনের শোগান 'স্বাধীন গণমাধ্যমই গণতন্ত্র'। যদিও আমরা জানি, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ধারণাটির একরৈখিক কোনো অর্থ হয় না বরং এটি অতি-অবশ্যই একটি ব্যাখ্যামূলক প্রত্যয়। মূলধারার গণমাধ্যমের স্বাধীনতা মানে মালিক, বিনিয়োগকারী, বিজ্ঞাপনদাতা ও কর্পোরেট শ্রেণীর স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতা মূলধারার গণমাধ্যমের চরিত্রকে গণমুখী করবে বলে মনে করার কোনো কারণই নেই। সীমাহীন স্বাধীনতা বরং কর্পোরেট গণমাধ্যমের মুনাফা কামানোর স্বেচ্ছাচারিতাকে উস্কে দিতে বাধ্য এবং তাতে প্রাম্ভিক জনগোষ্ঠীর কল্যাণের কোনো সুযোগ নেই। বরং আমি মনে করি, গণতান্ত্রিক, সমন্বিত ও যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে কর্পোরেট গণমাধ্যমকে সার্বক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রীয় নজরদারিতে থাকা প্রয়োজন তাতে যদিও-বা কর্পোরেট গণমাধ্যমকে কিছুটা দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহিতার বেড়াজালে আনা যায়। সরকার ও গণমাধ্যম পরস্পর পরস্পরকে অষ্টপ্রহর প্রহরীর মতো পাহারা দেবে যেন উভয় পক্ষই তার দায়িত্বশীলতা এবং জবাবদিহিতা বিস্মৃত না হয়। প্রকৃত গণতন্ত্রে স্বাধীনতা যেমন একটি গুরত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ তেমনি জবাবদিহিতাও তার এক অনিবার্য নিয়তি।


তো, যে আলোচনা চলছিলো, নব্বই'র গোড়াতে বাজার-অর্থনীতির ঘাড়ে সওয়ার হয়ে বিশ্বের অপরাপর দেশের মতো বাংলাদেশেও আগমন ঘটলো কথিত গণতন্ত্রের। নয়া এ গণতান্ত্রিক পরিমলে সময়ের দাবিতে সংবাদপত্র প্রকাশ সংক্রান্ত 'বিশেষ আইন- ১৯৭৪' বাতিল হয়ে যায় এবং অতিদ্রুত গঠিত হয় সরকারীকরণ বোর্ড। ত্বরিত অনুমোদন পেয়ে যায়, বৈশ্বিক স্যাটেলাইট সম্প্রচার, মোবাইল নেটওয়ার্ক, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ইত্যাদি ইত্যাদি। ক্রমশ মধ্যবিত্তের চৌহদ্দি বাড়তে থাকে। বৈশ্বিক স্যাটেলাইট চ্যানেল ও অন্যান্য অনুষঙ্গ বাড়াতে থাকে তাদের অন্তর্গত স্বাদ- আহ্লাদও। মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নিজস্ব স্বপ্ন-কল্পনা। আহা আমাদেরও যদি থাকতো! ফলে আর দেরি কেন? ইতিমধ্যেই হিসেব-নিকেশ ফয়সালা। ১৫ কোটির বাজার বলে কথা! বাজার অর্থনীতির যুগে বাজারের সাইজ জানা এবং সে-মতো করণীয় নির্ধারণ করাইতো হবে চলমান গণতন্ত্র তথা উন্নয়নের মূলমন্ত্র। পালাগুস্মি সাইনাথরা বলুক গে, ‘মূল সমস্যাকে সুকৌশলে এড়িয়ে যাওয়াই হচ্ছে উন্নয়ন'। আমরা সে কথায় কান দেব কোন দুঃখে!


তো বাজারের সাইজটা যেহেতু পাওয়া গেল, সুতরাং গণতন্ত্র সুরক্ষা এবং উন্নয়ন সুনিশ্চিত করতে একের পর এক গণমাধ্যম চাই। আর একুশ শতকের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা তো আর প্রিন্ট মিডিয়া দিয়ে হবে না, দরকার নিত্য-নতুন স্যাটেলাইট চ্যানেল। কেননা, উন্নয়নের জোয়ার ডিজিটালি পৌঁছে দিতে হবে জনগণের দোর-গোড়ায়। সাড়ম্বরে শুরু হয়ে গেলো জেমস কারানের ভাষায়, 'মার্কেট ওরিয়েন্টড জার্নালিজম'। বিজ্ঞাপনদাতা-গণমাধ্যম যৌথ সমঝোতার ভিত্তিতে অডিয়েন্স নিয়ত ভোগ করে চললো সংবাদরূপী পণ্য যাকে বলে 'কমোডিফিকেশন অব নিউজ'। ইয়ুর্গেন হাবেরমাস চিহ্নিত অষ্টাদশ শতকের কথিত 'জনপরিসরের' পরিবর্তে ছোট পর্দায় তৈরি হতে থাকলো একটি বৃহৎ খাদক-পরিসর। বিচিত্র কলা-কৌশলে কর্পোরেট ও ক্ষমতাসীনদের স্বার্থ সুরক্ষার দক্ষ ওয়াচডগ কিংবা প্রহরীর পরিচয় দিতে থাকলো মাধ্যমটি। সংবাদের আড়ালে নিরবিচ্ছিন্ন বিজ্ঞাপন প্রচার করে সর্বোচ্চ পুঁজিবাদী দেশ যুক্তরাষ্ট্রকেও এ ক্ষেত্রে পেছনে ফেলে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল। ফেডারেল কম্যুনিকেশন কমিশনের (এফসিসি) নীতিমালা অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে যেখানে প্রাইম-টাইমে ঘণ্টায় আট মিনিটের বেশি বিজ্ঞাপন প্রচার করা নিয়মবহির্ভূত, সেখানে উল্টো রথে চলছে স্বদেশ। বিজ্ঞাপন দখল-বেদখল-পুর্নদখল করে নিচ্ছে টিভি অনুষ্ঠানের শিরোনাম; নির্ধারণ করে দিচ্ছে অনুষ্ঠানের উপস্থাপক, অনুষ্ঠান প্রচার-সময়, সংবাদ নির্বাচন এমনকি সংবাদ-কাঠামোটিও। ইনফোটেইনমেন্ট (ইনফরমেশন+এনটারটেইনমেন্ট)-ই হয়ে দাঁড়াচ্ছে টিভি চ্যানেলের প্রধান ও একমাত্র কাজ। আর একমুঠো এনটারটেইনমেন্টের মধ্যে এক চিমটি বাজার-সংশিষ্ট ইনফরমেশন দর্শনে যেকোনো দর্শক মনে করতে পারেন, টিভির একমাত্র কাজ হচ্ছে এনটারটেইনমেন্ট, এনটারটেইনমেন্ট অ্যান্ড এনটারটেইনমেন্ট। দয়া কিষাণ থুজু ভারতীয় প্রেক্ষপটে যেটিকে শনাক্ত করেছেন, ‘মারডকাইজেশন অব নিউজ' (Murdochization of news) বলে। এদিকে শুধু নিজ মাধ্যমের অনুষ্ঠান নির্মাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি স্যাটেলাইট চ্যানেল, সংস্কৃতি- সেবা-সম্প্রসারণ-নীতির অংশ হিসেবে রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণেরও গুরু দায়িত্ব পালন করে চলছে। ফলে টিভি চ্যানেল প্রযোজিত ও পরিবেশিত চলচ্চিত্র দর্শকদের সাথে চলচ্চিত্র ও নির্মাতার প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিন্ন করে বিজ্ঞাপনদাতা অর্থাৎ কর্পোরেট কর্তৃত্বকে প্রতিষ্ঠা করে চলছে গত এক দশকের বেশি সময় ধরে। চলচ্চিত্র নির্মাতা, প্রযোজক ও পরিবেশক দর্শক-শ্রোতার কাছে দায়বদ্ধ না থেকে, থাকছে বাণিজ্যিক কর্পোরেশনের কাছে। ফলে সঙ্গত কারণেই সিনেমা হল ভেঙ্গে সেখানে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে নিত্য নতুন শপিং মল। দ্রতই সিনেমা হলের সংখ্যা দেড় হাজার থেকে নেমে ঠেকেছে তিনশ'র কাছে-পিঠে।


কথিত আছে, মালিক শ্রেণির কালো টাকা সাদা করা এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল কিংবা প্রচারযন্ত্র হিসেবে কাজ করা নিত্য-নতুন টিভি চ্যানেল আত্মপ্রকাশের অন্যতম প্রধান একটি কারণ। বলাবাহুল্য, 'কালো টাকা সাদা করা' ধারণাটির মধ্যে বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গী সুস্পষ্ট। কালোকে নেতিবাচক এবং সাদাকে ইতিবাচক প্রতীকে দেখানোর এটি একটি অসংবেদনশীল প্রয়াস। ফলে দ্বি-দলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থায় প্রতি মেয়াদে নিদেনপক্ষে ডজন খানেক চ্যানেলকে অনুমতি দিয়ে নিজ নিজ দলকে সুরক্ষা দেয়ার দায়িত্ব নিচ্ছে সরকার। আর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল মালিক সমিতিকে স্যাটেলাইট চ্যানেল নীতিমালা তৈরির দায়িত্ব দিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোকেই আশু কর্তব্য বলে বিবেচনা করছে সরকার। ইতোমধ্যেই দুই ডজনেরও বেশি চ্যানেল দশর্ক- সেবা করার সুযোগ পেয়েছে আর ক্রমশ থিতিয়ে পড়ছে মধ্যবিত্তের পূর্বতন সব দাবি-দাওয়াসমূহ: বেতার-টিভির স্বায়ত্তশাসন, সরকারি বিজ্ঞাপন নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ইত্যাদি। এত সব স্বদেশি চ্যানেল থাকা সত্ত্বেও সুশীল মধ্যবিত্তের চেতনায় এখনো নোঙর গেড়ে আছে ভিনদেশি চ্যানেল। সন্ধ্যার পর ঢাকার যেকোনো মহল তার গলি-ঘুপচিতে প্রবেশ করলেই কর্ণরন্ধ্রে অনায়াসে সুড়সুড়ি মিলবে বিভিন্ন ভারতীয় বাংলা (জি, জলসা, ইটিভি, তারা, সঙ্গীত ইত্যাদি) স্যাটেলাইট চ্যানেলের। আর হিন্দির ক্রমবর্ধমান দাপটে বাংলা ক্রমশ পরিণত হচ্ছে একটি বান্দি (বাংলা+হিন্দি) ভাষায়। অথচ বাঙালি বা বাংলাদেশি কোনো প্রজাতির জাতীয়তাবাদীদেরই এ নিয়ে বিশেষ মাথা ব্যথা আছে বলে মনে হয়নি কখনও। আর অন্যদিকে গঙ্গা, তিস্তা আর সীমান্ত ইস্যুর মতো অসমাপ্ত, অকার্যকর আর অনুচ্চারিত রয়ে গেছে ভারতে বাংলাদেশি টিভি সম্প্রচারের বিষয়টিও। উভয় দেশের কর্তাব্যক্তিরা মাঝে মাঝে মুখ খোলেন বটে, হয়তো বাকি পুরো সময়টা কুলুপ এঁটে রাখার জন্য। প্রচার আছে, পশ্চিমবঙ্গের কেবল আপারেটররা বাংলাদেশি চ্যানেল মালিকদের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা দাবি করছে নয়তো সম্প্রচার করবে না বলে সাফ জানিয়েছে। আর বাংলাদেশের চ্যানেল মালিকরা মনে করছেন, ওটা কস্ট-ইফেকটিভ হবে না। সমালোচকরা অবশ্য বলছেন, পশ্চিমবঙ্গে বাংলাদেশি পণ্যের বাজার বিস্তার ঠেকাতেই দেব-দিচ্ছি বলে ওপার বাংলার এ লুকোচুরি।


মাওবাদী ও ভারত সরকারের একজন মধ্যস্থতাকারী হিসেবে অরন্ধতী রায় ২০১০ সালে শুরুর দিকে ভারতের ছত্তিশগড়ের দাড়েশ্বরী মন্দিরে গিয়েছিলেন। সমস্যা সমাধানকল্পে স্থানীয় পুলিশ সুপার অরন্ধতী রায়কে একটি প্রস্তাব দেন। প্রস্তাবটুকু পুলিশ সুপারের মুখেই শোনা যাক, ‘দেখুন ম্যাম, খোলাখুলি বলি, এই সমস্যার সমাধান পুলিশ বা সেনাবাহিনী দিয়ে হবে না। এসব উপজাতীয়দের সমস্যা হলো, তারা লোভ বোঝে না। তাদের লোভী করে তুলতে না পারলে আমাদের কোনো আশা নেই। আমি আমার বসকে বলেছি, বাহিনীগুলো সরিয়ে নিন আর প্রত্যেক আদিবাসীর বাড়িতে একটি করে টেলিভিশন দিয়ে দিন। দেখবেন, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে'। ফলে লোভী করে তুলতে যে টেলিভিশনের বিকল্প নেই সেটা বুঝতে পারা খোদ ছত্তিশগড়ের পুলিশ সুপারের কাছেও জলবৎ-তরলসম।


তবে কি এ কারণেই টিভিকে ‘ইডিয়ট বক্স' বলা হয়? পাঠক আপনাদের মধ্যে আমার মতো যারা অ-জ্ঞানী কিংবা অজ্ঞানী রয়েছেন তারা হয়তো এমনটিই ভাববেন। হয়তো ভাববেন, আমারা নিজেরা ইডিয়ট বলে টিভি দেখি, নয়তো টিভি দেখতে দেখতে এক সময় নিজেরাই ইডিয়ট বনে যাই? ধাঁধাঁ বটে! তবে ইডিয়ট বক্সটি সত্যিই গোটা মানব জাতিকে যে এড়ার সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে তা খানিকটা উন্মোচিত হয় সম্ভবত এই কথায় "The human race is faced with a cruel choice: work or television"|

খ. আলম: সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

আ.দৈ/এ রউফ

Link copied!