শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
Ajker Dainik

ঢাকা দুই সিটিতে চার বছরের কি উন্নয়ন  হয়েছে: আইপিডি

আজকের দৈনিক | নিজস্ব প্রতিবেদক 

প্রকাশিত: মে ১৪, ২০২৪, ০৮:৩৫ পিএম

ঢাকা দুই সিটিতে চার বছরের কি উন্নয়ন  হয়েছে: আইপিডি
ছবি সংগৃহিত

ঢাকার নাগরিক সেবা ও বাসযোগ্যতা বাড়াতে মেয়র ও কাউন্সিলরদের জবাবদিহিতা এবং উন্নয়ন কাজে এলাকাবাসীর সম্পৃক্ততা বাড়ানো দরকার বলে অভিমত ব্যক্ত করেছেন  ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)  আয়োজিত অনুষ্ঠানে আলোচক গণ।


মঙ্গলবার (১৪ মে) আইপিডি'র আয়োজিত "ঢাকা উত্তর এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলরদের মেয়াদের চার বছর: নাগরিকদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি" শীর্ষক  আইপিডি নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়ন পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে আলোচকগণ পক্ষে বিপক্ষে নানা অভিমত ব্যক্ত করেছেন। 

 আলোচকগণ বলেন, ঢাকা উত্তর এবং ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলরদের নিকট নগরবাসীর প্রত্যাশা ছিল অনেক। জনবহুল এবং চ্যালেঞ্জিং এই শহরে নাগরিকদের চাওয়া গত চার বছরে প্রত্যাশা অনুযায়ী পূরণ করতে না পারলেও ঢাকার দুই মেয়রের জলাবদ্ধতা নিরসন, খাল সংস্কার ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ নগরের বেশ কিছু সমস্যা সমাধানে আন্তরিক উদ্যোগ ছিল।

 আবার বাস রুট রেশনালাইজেশন, ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট, ফুটপাত দখলমুক্ত রাখাসহ ইশতেহারে প্রতিশ্রুত অনেক বিষয়েই কার্যকর পরিকল্পনা ও উদ্যোগ দেখা যায়নি। আবার খাল উদ্ধার ও বর্জ্য অপসারণ করা হলেও সেখানে নজরদারি ও ব্যবস্থাপনার অভাবে খালের প্রবাহ পুনরায় মরে যাওয়া কিংবা উন্নয়নকৃত খেলার মাঠে জনগণের প্রবেশাধিকার সংকুচিত হয়ে যাবার মত উদাহরণ ও দেখা গিয়েছে।

 পাশাপাশি ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের অনেকেরই জনসম্পৃক্ততা ছিল না, অনেকের বিরুদ্ধে খাল ও জমি দখল এবং দূর্নীতির অভিযোগ ও পাওয়া গেছে। সামনের দিনগুলোতে সিটি কর্পোরেশনকে আরো কার্যকর ও জনবান্ধব করতে ওয়ার্ড এবং এলাকাভিত্তিক চাহিদা নিরূপণ করে অগ্রাধিকারভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি এবং ওয়ার্ড মাস্টার প্ল্যান প্রণয়ন সম্পন্ন করে দ্রুত বাস্তবায়ননের মাধ্যমে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও সেবার মান বাড়াতে হবে ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন'কে।


মূল প্রবন্ধে আইপিডির পক্ষ থেকে পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকার দুই মেয়রের ইশতেহারে প্রতিশ্রুত অনেক বিষয়ই সিটি করপোরেশনের আওতাধীন ছিল না। এগুলো ভোটারদের আকৃষ্ট করতেই বলেছিলেন তারা। আবার আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশনের কর্মপরিধিও ব্যাপক।

 গত চার বছরে ঢাকা উত্তরের মেয়র আতিকুল ইসলাম খাল উদ্ধার ও জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেনযার মধ্যে মোহাম্মদপুরের লাউতলা ও রামচন্দ্রপুর খাল, মিরপুরের প্যারিস খাল এবং সাতারকুলের সূতিভোলা খাল থেকে দখলদারদের উচ্ছেদ ও আবর্জনা অপসারণ উল্লেখযোগ্য।

 ঢাকা উত্তরের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে - বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন স্থাপন, নতুন যুক্ত হওয়া ১৮ টি ওয়ার্ডের মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন, হকার ব্যবস্থাপনায় পাইলট প্রজেক্ট, নিম্ন আয়ের বসত এলাকায় সবুজায়ন ও অগ্নি ঝুঁকি কমাতে ফায়ার হাইড্রেন্ট, ফ্লাইওভারের পিলারে দৃষ্টিনন্দন স্ট্রিট আর্ট, ই-ট্রেড লাইসেন্স সেবা, নাগরিক সেবা সংশ্লিষ্ট সবার ঢাকা অ্যাপ প্রভৃতি। 

আইপিডির পক্ষ থেকে বলা হয়, আদি বুড়িগঙ্গা চ্যানেল পুনরুদ্ধার করবার উদ্যোগটি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ। এছাড়া ডিএসসিসির অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হল- শ্যামপুর, মান্ডা, জিরানী ও কালুনগর খালে উদ্ধারের প্রকল্প, পর্যটন ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে ঐতিহ্য বলয় বাস্তবায়ন এবং ঢাকা ফটক ও লালকুঠির পুনঃসংস্কার কাজ, ইন্ট্রিগ্রেটেড মাস্টারপ্ল্যান ফর ঢাকা সিটি) এর মাধ্যমে ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনা প্রণয়ন এর উদ্যোগ, রাজস্ব আয় বৃদ্ধি ও কর্পোরেশন এর দূর্নীতি দূরীকরণ এর উদ্যোগ; নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষমতা বৃদ্ধি, রিকশাসহ অযান্ত্রিক যানবাহন নিবন্ধনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং ডিজিটাল নম্বর প্লেট প্রদান। 

ডিএনসিসির প্রধান চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে রয়েছে - মশা নিয়ন্ত্রণে সফলতা নেই, স্কুল বাস চালুর ঘোষণা সত্বেও অগ্রগতি নেই, নতুন ওয়ার্ডগুলোর পরিকল্পনা প্রণয়ন হলেও অর্থায়নের অভাবে পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি কম, বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন উদ্যোগে পরিবেশগত প্রভাবের শংকা, খালে উদ্ধার ও বর্জ্য পরিষ্কার উদ্যোগসমূহ টেকসই হচ্ছে না ও কমিউনিটির সম্পৃক্ততার অভাব রয়েছে।


 পক্ষান্তরে ঢাকা দক্ষিণের ক্ষেত্রে এই সংকটগুলো হচ্ছে- খেলার মাঠগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ক্লাব এর দখলে, পার্ক ইজারা দেবার কারণে বাণিজ্যিক ব্যবহার বাড়ছে, উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় এলাকাবাসীর মতামত, সম্পৃক্ততা ও অংশগ্রহণ এর সুযোগ কম, উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে ওসমানী উদ্যান-শিশুপার্ক দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ, পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউন সরানোর ব্যাপারে কার্যকর উদ্যোগ এর অভাব, ফলে বিশাল সংখ্যক মানুষ অগ্নিঝূকিতে, ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার জন্য কার্যকর পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেই। 

আইপিডি বলছে, ঢাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর'দের জনসম্পৃক্ততা দিন দিন কমছে৷ এলাকার পরিকল্পনা ও উন্নয়ন উদ্যোগ এ কাউন্সিলরদের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে, রয়েছে ওয়ার্ড কাউন্সিল অফিস এর সক্ষমতার অভাব।  ঠিকাদারি ও ব্যবসায় আগ্রহ এবং এতে কাউন্সিলরদের আত্মীয়-পরিজন'দের এর সম্পৃক্ততার অভিযোগ এর পাশাপাশি এলাকাবাসীর কাছে জবাবদিহিতার অভাব আছে। খাল, জমি দখল এর অভিযোগ এর পাশাপাশি দূর্নীতি ও চাদাবাজির অভিযোগ ও রয়েছে অনেক কাউন্সিলর এর বিরুদ্ধে। এইসকল সমস্যা দূর না করতে পারলে ওয়ার্ড কাউন্সিল থেকে কার্যকর নাগরিক সেবা ও নগর উন্নয়ন সম্ভব নয়।


অনুষ্ঠানে আইপিডির উপদেষ্টা  অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন,কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও জলাবদ্ধতা সরাসরি সম্পর্কিত তাই খাল উদ্ধার থেকে শুরু করে বর্জ্য অপসারণে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডসমূহে নাগরিক সুবিধা অপর্যাপ্ত। কাউন্সিলর অফিস উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু ধরে কাউন্সিলরদের জবাবদিহিতা, জনসম্পৃক্ততা, এবং তৎপরতা নিশ্চিত করতে হবে। রাজস্ব বাড়ানো এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে ও ইন্টারেক্টিভ রাজস্ব ম্যাপ তৈরি করতে হবে। 

আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, মেয়রদ্বয়ের বাকি এক বছরে দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম সম্পন্ন করা কঠিন বিধায় সেই চিন্তা করে ভবিষ্যত পরিকল্পনা ঠিক করতে হবে।

পরিকল্পনাবিদ রাকিবুল হক বলেন, সাতমসজিদ রোডের ডিভাইডারের গাছ কেটে ফেলায় পথচারী ও খেটে খাওয়া মানুষের দুর্ভোগ এবং তাপমাত্রা বেড়েছে। একইভাবে মহাখালী থেকে গুলশান পর্যন্ত রোডের ডিভাইডারের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। মেয়র ও কাউন্সিলরদের এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে দেখা যায়নি। এই শহরে গাছপালার চেয়ে বিলবোর্ডের সংখ্যা বেশি। অথচ গাছপালা কাটতেই নগর সংস্থাসমুহের আগ্রহ বেশি।


জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক ড. ফরহাদুর রেজা বলেন, এলাকাভিত্তিক ওয়ার্ড অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়ন করতে হবে। বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার মাধ্যমে দূষণ প্রতিরোধে সমন্বিত পরিকল্পনা করতে হবে। ল্যান্ডফিল এবং সেকেন্ডারী ট্রান্সফার স্টেশনের ক্ষেত্রে যথাযথ ভূমির উপযুক্ততা বিশ্লেষণ বা মানদণ্ড ছাড়াই নির্মাণ করা হয়েছে, যা নগরের দূষণ বাড়াচ্ছে। 

পরিকল্পনাবিদ দ্বীপ দাস বলেন, পুরান ঢাকার ধোলাইখালের উন্নয়ন কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও আড়াই বছর ধরে সীমানা নির্ধারণের জটিলতায় বাস্তবায়িত হয়নি। ধোলাইখালের মোটর পার্টস মার্কেট হতে উৎপন্ন বিষাক্ত রাসায়নিক ও ভারী ধাতু (হেভি মেটাল) পরিবেশের পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ হলে ও মেয়র বা কাউন্সিলরদের এ বিষয়ে ভূমিকা নিতে দেখা যায়নি।উন্নয়ন গবেষক রেদওয়ানুর রহমান বলেন, শহরের বাসযোগ্যতা বাড়াতে নেচার বেসড সলিউশন, গ্রীণ ও ব্লু নেটওয়ার্ক বাড়ানো এবং কংক্রিট এলাকা হ্রাসে উদ্যোগ নিতে হবে। 


-ঢাকার উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকর নগর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন নগর সংস্থাসমুহের সাথে নিয়মিত আলোচনার মাধ্যমে করণীয় নির্ধারণ। আলোচনক অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন ইয়াসির আমিন, শর্মিলা ইসলাম, মনিম আব্দুল্লাহ, ফাইজুর রহমান, জিহাদ আব্দুল্লাহ প্রমুখ।
 আ. দৈনিক / একে
 

Link copied!