শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
শনিবার, ২৭ জুলাই, ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১
Ajker Dainik

নীলফামারীতে পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে মাসব্যাপি পালকি উৎসব

আজকের দৈনিক | মোঃ হারুন উর রশিদ, নীলফামারী:

প্রকাশিত: মে ২৬, ২০২৪, ০৭:৪১ পিএম

নীলফামারীতে পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখতে মাসব্যাপি পালকি উৎসব
নিজস্ব ছবি

এবার নীলফামারীতে ব্যতিক্রম দৃশ্য, মাসব্যাপি পালকি উৎসবের আয়োজন করেছেন, রুহুল আমিন নামে একজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক। গত পহেলা মে থেকে শুরু হয়েছে তার এই উৎসবটি। উপজেলার উত্তর দুরাকুটি গ্রামে অবস্থিত সৃষ্টি বৈকালিন শিক্ষাকেন্দ্র সংলগ্ন এক সংগ্রহ শালায় সুন্দরভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে পালকিটি। তিনি গ্রামবাংলার পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যই মাসব্যাপি এই পালকি উৎসবের আয়োজন করেছেন বলে সাংবাদিকদের জানান।

আমাদের প্রতিনিধি হারুন উর রশিদ মনের মাধুরি মিশিয়ে সুন্দভাবে পালকি নিয়ে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন। তার পাঠানো প্রতিবেদনটি নিম্নে তুলে ধরা হলো;

একসময় চাকাবিহীন ঐতিহ্যবাহী কাঠের তৈরি চৌকানো আয়তাকার বাক্সের নাম ছিল পালকি। এর দুপাশে দুটি দরজা থাকে এবং দুই মাথায় দুটি লম্বা মোটা কাঠের হাতল থাকে। যা কাঁধে নিয়ে বেহারারা তা বহন করত। প্রত্যেক আয়োজনে পালকিকে সাজানো হত দামি কাপড় দিয়ে।

গ্রামবাংলার এই চাকাবিহীন ঐতিহ্যবাহী বাহনে চড়ে রাজা-বাদশাসহ অভিজাত পরিবারের লোকজনের যাতায়াত এবং নববধূ ও বরকে পরিবহণ করা হতো। এ বাহনের সহজ নির্মানশৈলী,আয়েশি চলাফেরা,রাজকীয় মর্যাদা,বর-কনের নান্দনিক বহন, বহনকারি বেহারাদের মুখে ছন্দ তোলা হৃদয় দোলানো গানের সুর বাঙালির মানষপটসহ শিল্প-সাহিত্যে বিশেষ অবস্থান করে নেয়।

পালকি নিয়ে বিভিন্ন ছড়া, গানও লেখা হয়েছিলো। যেমন- ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন- পালকি চলে! পালকি চলে! গগন-তলে আগুন জ্বলে..। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বীরপুরুষ কবিতায় লিখেছেন- মনে করো যেন বিদেশ ঘুরে- মাকে নিয়ে যাচ্ছি অনেক দুরে। তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে- দড়জা দুটো একটুকু ফাঁক করে। শিশুতোষ এমন নানা ছড়া, কবিতায় নানান উপমায় কবি-সাহিত্যিকদের লিখনিসহ নাটক-সিনেমায় বার বার উঠে এসেছে পালকির কথা। কিন্তু আধুনিক যুগের জাঁকজমকপূর্ণ কার,বাস,মাইক্রোবাস পরিবহনের কারণে পিষ্ট হয়েছে বেহারা ও তাদের কন্ঠের ছন্দমাখা সুর আর হারিয়ে গেছে পালকি। আর এই ঐতিহ্যের স্মৃতিকে লালন করতে পালকি সংরক্ষণ করা হয়েছে যাদু ঘরে, লোককারু শিল্পে ও বইয়ের পাতায়।

তবে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে বই কিংবা ওইসব স্থানে গিয়ে নয়,বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের মাঝে পালকির ঐতিহ্য তুলে ধরতে মাসব্যাপি চলছে পালকি উৎসব। এর আয়োজন করেন রুহুল আমিন নামে এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক।

প্রথমত তিনি নিজস্ব অর্থায়নে পালকি তৈরি করে তা সম্প্রতি সময়ে পহেলা বৈশাখে উপজেলার শহর-গ্রাম, পাড়া-মহল্লায় ঢাক-ঢোল পিটিয়ে রাস্তায় বের হন। এরপর পহেলা মে উপজেলার উত্তর দুরাকুটি গ্রামে অবস্থিত সৃষ্টি বৈকালিন শিক্ষাকেন্দ্র সংলগ্ন এক সংগ্রহ শালায় রাখা হয় পালকিটি। সেখানে এ উৎসব চলবে মাসব্যাপি। পালকি দেখার জন্য নানা প্রান্তের মানুষ ভিড় করছেন প্রতিনিয়ত।

ওই শিক্ষক বলেন, পালকির ঐতিহ্য বর্তমান ও নতুন প্রজন্মের মাঝে তুলে ধরার পাশাপাশি এ প্রজন্মের ছেলে-মেয়েদের পালকিতে চড়ে বিয়ের আবদার মেটাতে এমন প্রয়াস।

প্রবীণরা বলেন, এক সময় বর-কনে বাহনের অন্যতম মাধ্যম ছিল পালকি। যারা পালকি বহন করতো তাদেরকে বেহারা বলা হত। তারা যখন রঙিন ঝালর দেওয়া আর নানা রঙের ফুল কাগজে সাজানো পালকিতে নতুন বউকে নিয়ে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে হেঁটে যেতেন তখন তাদের ছন্দবদ্ধ কন্ঠে ভেসে উঠত হুন হুনা হুনরে, চার বেহারার পালকিতে চড়ে যায়রে কন্যা পরের ঘরে..। কর্তাবাবুর রঙটি কালো, গিন্নি মায়ের মনটি ভাল, সামলে চলো হেঁইও হেঁইও জোয়ান সরু আল চলো ধীরে, কর্তাবাবুর দরাজ দিল দেবে ছিড়ে..।

 এমন ছন্দতোলা হৃদয় দোলানো সুর শুনে উৎসুক পরশিরা রাস্তার পাশে দাঁড়াত লাল শাড়ি পড়া ঘোমটা দেওয়া নববধূর মুখখানি দেখার জন্য। এছাড়াও মেহেদি তোলার প্রতিটি দৃশ্যের বর্ণনায় উঠে আসত বেহারাদের সুরে-ছিল মেন্দি হিন্দুস্তানে, আইলো মোন্দি পাকিস্তানে,এই মোন্দি তুলিবে কে? দুলাইনের বড় ভাবিরে।

তারা আরও বলেন, বরের বাড়ির সামনে আসলে ছেলের মাকে খুশি করার জন্য বেহারা ধরতেন নতুন গান- আল্লাবোল, ওরে বোল, মাইয়ার মারে দিস গোল, পোলার মারে স্বর্গে তোল সেই কোদালে ছাঁচে হিসে দুলার বাপের বাড়ি রে, সেই কোদালে ছাঁচে দুলহানের বাপের দাড়ি রে..। শুধু পালকি নয়, পালকি বেহারাদের এমন সুনিপূণ নানা ছন্দমালা হৃদয় দোলানো গানের সুর মুগ্ধ করেছিল সবাইকে।

কিশোরীগঞ্জ মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক শাহিন ইসলাম বলেন, পালকি শব্দটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ পালঙ্ক থেকে, যার অর্থ শয্যা বা বিছানা। আর উপমহাদেশে পালকির প্রচলন কখন হয়েছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে। তবে পালকির উৎপত্তির সঠিক ইতিহাস জানা না গেলেও বাল্মিকীর রামায়ণে পালকির কথা উল্লেখ রয়েছে। তাই ধারণা করা হয় আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে ভারতীয় উপমহাদেশে পালকির প্রচলন শুরু হয়েছিল।

একসময় সব শ্রেণিপেশার সৌখিনপ্রিয় বাঙালির বিলাসবহুল বাহন ছিল পালকি। কালেরবির্বতনের পালকির প্রচলন হারিয়ে গেছে। তাই সেই সময়ের স্মৃতি সংরক্ষণপূর্বক নতুন প্রজন্মের মাঝে বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরতে সংশ্লিষ্টদের এগিয়ে আসতে হবে।


আ. দৈনিক/ একে/ হারুন

Link copied!