রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪,
৩১ ভাদ্র ১৪৩১
ই-পেপার

রবিবার, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
অপরাধ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি করে হত্যা: কবর থেকে তোলা হচ্ছে লাশ
আন্দোলনে হতাহতদের পরিচয়সহ পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরি করতে কমিটি গঠন
সুশান্ত সাহা
Publish: Tuesday, 3 September, 2024, 8:44 PM

সংঘাত-সহিংসতাসহ যে কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় ময়নাতদন্ত করা বিধান থাকলেও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে সহিংসতায় ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় ৭ শতাধিক মানুষ নিহত হয়েছেন, তাদের একটি বড় অংশকেই সমাধিস্থ করা হয়েছে ময়নাতদন্ত না করেই। ঠিক কতগুলো মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই দাফন করা হয়েছে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। এক্ষেত্রে ঘটনাস্থলেই যাদের মৃত্যু হয়েছে, পুলিশি ঝামেলার ভয়ে তাদের স্বজনদের অনেকেই লাশ সরাসরি বাড়িতে নিয়ে দাফন করেছেন বলে জানা যাচ্ছে।

 অন্যদিকে, যাদের মৃত্যু হাসপাতালে হয়েছে, তাদের বিষয়ে খবর দেয়া হলেও পুলিশ অনেকক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত করার ব্যাপারে আগ্রহ দেখায়নি বলেও অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। যদিও পুলিশ সেটি অস্বীকার করেছে। তবে, মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, ‘নিজেদের রক্ষা করতেই পুলিশ ময়নাতদন্ত এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে।’ এসব মৃত্যুর ঘটনার সঙ্গে পুলিশের নামও জড়িত রয়েছে। ফলে তারা নিজেদের গাঁ বাঁচানোর চেষ্টা থেকেই এসব করছে। 

জানা যায়, রাজধানীর রায়েরবাজার কবরস্থানেই দাফন হয়েছে শতাধিক বেওয়ারিশ লাশ। এর মধ্যে গত একমাসে আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম দাফন করেছে ৮১টি। তবে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে কতো মানুষ হতাহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেছেন তার সঠিক সংখ্যা এখনও অজানা। জুলাইয়ের ১৭, ১৮ এবং ১৯ তারিখ গুলিবিদ্ধ মানুষের আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতাল। একের পর এক মরদেহের স্তূপে পূর্ণ হয়েছিল লাশঘর। রাজধানীতে বেওয়ারিশ লাশ দাফনে এগিয়ে আসে দাতব্য সংস্থা আঞ্জুমান মফিদুল ইসলাম। শুধু জুলাই মাসেই রায়েরবাজার কবরস্থানে সংস্থাটি দাফন করে ৮১টি বেওয়ারিশ লাশ, যার সবাই আন্দোলনে শহীদ।

 এখনও রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন গুলিবিদ্ধ অনেকে। গণহত্যায় জড়িতদের বিচারের পাশাপাশি বেওয়ারিশ সবার পরিচয় শনাক্তের দাবি উঠেছে। রায়েরবাজার কবরস্থানের দীর্ঘদিনের কর্মী গোলাম রব্বানী জানালেন, গণ অভ্যুত্থান সময়ের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার কথা। তিনি বলেন, কবর আগেই খনন করা থাকতো। পুলিশ এক সঙ্গে ১০-১২টা লাশ নিয়ে এসে সাইডে ফেলে রেখে যেতো। এরপর আমরা ওই লাশগুলো দাফন করতাম।

এদিকে রংপুরে দাফনের ৪৪ দিন পর কবর থেকে তোলা হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত সবজি বিক্রেতা সাজ্জাদ হোসেনের লাশ। তদন্তের স্বার্থে এ লাশ উত্তোলন করা হয়। গত সোমবার দুপুরে কবর থেকে লাশটি তুলে ময়নাতদন্তের জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। রংপুর জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সিনিয়র সহকারী কমিশনার এটিএম আরিফ হোসেন ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রংপুর মেট্রোপলিটন কোতোয়ালি থানার এসআই তালেব উদ্দিন লাশ উত্তোলনের সময় উপস্থিত ছিলেন। 

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই তালেব উদ্দিন বলেন, মামলার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে আদালতের আদেশক্রমে সাজ্জাদ হোসেনের লাশ কবর থেকে উত্তোলন করা হয়েছে। পরে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য তার লাশ পাঠানো হয়। লাশ উত্তোলনের বিষয়টি নিশ্চিত করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এটিএম আরিফ হোসেন বলেন, আদালতের নির্দেশে সাজ্জাদ হোসেনের লাশ কবর থেকে উত্তোলনের পর সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। পরে লাশ ময়নাতদন্ত শেষ করে আবারো দাফন করা হয়েছে।

অপরদিকে গাজীপুরের সফিপুর আনসার অ্যাকাডেমির সামনে গত ৫ আগস্ট বেলা ২টার দিকে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন পোশাকশ্রমিক মো. আয়াতুল্লাহ(২২)। এ সময় পুলিশের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি ধাওয়া চলছিল আন্দোলনকারীদের। একপর্যায়ে নিখোঁজ হন আয়াতুল্লাহ। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিয়ে তাঁর সন্ধান পাওয়া যায়নি। গত শুক্রবার টেলিভিশনে বেওয়ারিশ লাশের খবর দেখে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে আয়াতুল্লাহর লাশের সন্ধান পেয়েছেন স্বজনেরা।

ফৌজদারি আইনবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন না থাকলে এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা যাবে না। ফৌজদারি কার্যবিধি ও পুলিশ প্রবিধান অনুযায়ী, অস্বাভাবিক মৃত্যুর শিকার কোনো ব্যক্তির লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ হস্তান্তরের কোনো সুযোগ নেই। আর ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হচ্ছে ফৌজদারি মামলার তদন্ত ও বিচারের অন্যতম অপরিহার্য উপাদান।

আইনজ্ঞরা বলছেন, ফৌজদারি কার্যবিধি পুলিশের প্রবিধান অনুযায়ী, কোনো থানা এলাকায় কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংবাদ পাওয়ামাত্র পুলিশ লাশ দেখতে যাবেন। এরপর মৃত্যুর কারণ নির্ণয় করে সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করবেন। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানতে মরদেহ পাঠাতে হবে ফরেনসিক চিকিৎসকের কাছে। ফরেনসিক চিকিৎসক ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করবেন। সেই প্রতিবেদনে মৃত্যুর কারণ লিপিবদ্ধ করবেন। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন খুনের মামলার অন্যতম সাক্ষ্য।

অস্বাভাবিক মৃত্যু হওয়া ব্যক্তির সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন তৈরির বিষয়ে পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেটের কী করণীয়, সে ব্যাপারে ফৌজদারি কার্যবিধির (সিআরপিসি) ১৭৪ ধারা ও পুলিশের প্রবিধানের (পিআরবি) ২৯৯ ধারায় বর্ণিত হয়েছে।

সিআরপিসির ১৭৪ ধারায় বলা হয়েছে, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বা কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যদি সংবাদ পান, কেউ আত্মহত্যা করেছেন বা দুর্ঘটনায় মারা গেছেন বা যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে, অপর কোনো ব্যক্তি অপরাধে জড়িত, তখন পুলিশ সেই ব্যক্তির সুরতহাল তৈরি করবেন। পরে মরদেহের ময়নাতদন্তের জন্য ফরেনসিক চিকিৎসকের কাছে পাঠাবেন। পিআরবির ২৯৯ ধারা অনুযায়ী, অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে পুলিশ ৪৮ নম্বর ফরমে অভিযোগ লিপিবদ্ধ করবেন। মৃত ব্যক্তির লাশ যেখানে আছে, সেখানে যাবেন পুলিশ পরিদর্শক বা সহকারী পরিদর্শক বা হেড কনস্টেবল। তদন্ত শেষে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রতিবেদন দেবেন। প্রত্যেক অস্বাভাবিক মৃত্যুর ক্ষেত্রে কেস ডায়েরি তৈরি করে তা সংরক্ষণ করতে হবে।

গুলিবিদ্ধ মৃতদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন ছাড়া লাশ হস্তান্তর করা আইনসিদ্ধ নয় বলে মনে করেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) নূর মোহাম্মদ। ৭ আগস্ট তিনি বলেন, আইন অনুযায়ী কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সংঘাত ও সংঘর্ষে ছাত্র, জনতা ও পুলিশের যেসব সদস্য মারা গেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন করা উচিত ছিল। কারণ, কোনো ব্যক্তির অস্বাভাবিক মৃত্যু হলে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত করতে হবে। ময়নাতদন্ত না হলে ওই ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ জানা যাবে না।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধি লঙ্ঘনের দায়ে জড়িত সংশ্লিষ্ট থানার পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে দ্রুত প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব খুনের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে হলে প্রতিটি মরদেহের ময়নাতদন্তের ব্যবস্থা করতে হবে।
 
আ. দৈ. /কাশেম / সুশা
আপনার মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

অগ্রণী ব্যাংকে ডেভেলপমেন্ট অব লিডারশিপ কোয়ালিটি অব ব্রাঞ্চ ম্যানেজমেন্ট প্রশিক্ষণ
রূপালী ব্যাংকের ব্যবসায়িক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত
এসডিজি ব্র্যান্ড চ্যাম্পিয়ন অ্যাওয়ার্ড পেল বিকাশ
সোনালী ব্যাংকের সাথে ট্যুরিজম বোর্ডের চুক্তি
জনতা ব্যাংকে মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত
আরো খবর ⇒

জনপ্রিয় সংবাদ

’ক্ষমতায় আসলে বিএনপি জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠা করবে ‘
বিএনপির কেন্দ্রীয় ত্রান তহবিলে সহায়তা দিলেন কামরুজ্জামান সোহাগ
আমিনবাজার ল্যান্ডফিলসহ চলমান উন্নয়ন প্রকল্প পরিদর্শন করলেন প্রশাসকের নেতৃত্বে ডিএনসিসির উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা
বাউফলে সভাপতির বিরুদ্ধে সম্পাদকের সংবাদ সম্মেলন
সোনাইমুড়িতে বন্যাদুর্গত ৪০০ পরিবারকে খাদ্য সামগ্রী দিয়েছে বাকোডিসি
অপরাধ- এর আরো খবর
সম্পাদক ও প্রকাশক : কামরুজ্জামান সাঈদী সোহাগ
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক : মাসুদ আলম
নির্বাহী সম্পাদক : মোঃ তৌহিদুর রহমান

প্রকাশক কর্তৃক ১১/১/বি উত্তর কমলাপুর, মতিঝিল থেকে প্রকাশিত
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : সাগুফতা ডি লরেল (তৃতীয় তলা), কমলাপুর বাজার রোড, মতিঝিল বা/এ, ঢাকা-১০০০

মফস্বল সম্পাদক : ০১৭৭৫৮১৮২৭৫, ফোন : ০১৭১২-৫০১২৩৬, ০২-৫৮৩১৬১০৯ , ই-মেইল : [email protected]
© ২০২৪ আজকের দৈনিক
🔝