বিশেষ প্রতিবেদকঃ সরকারী সবগুলো ব্যাংককে স্বৈরাচার ও ফ্যাসিস্ট সরকারের অনুগত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মুক্ত করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়। তবে তাদের পরিবর্তে যারা নিয়োগ বাগিয়েছেন তাদের নিয়ে নতুন করে সৃষ্টি হওয়া বিতর্কে অস্থির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিকখ্যাতি সম্পন্ন অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনায়েন সামী এ নিয়ে প্রকাশ করেছেন এক পোষ্ট। যাতে ফুটে উঠেছে এসব সুবিধাভোগিদের মূল চরিত্র। যার নেপথ্যে মিলেছে এক সময়কার ডিসি বদরে মুনীর ফেরদৌসের নাম। বর্তমানে অতিরিক্ত সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই কর্মকর্তার যোগসাজশে হুমকীর মুখে আবারো আর্থিকখাত।
বিগত ফ্যাসিষ্ট সরকারের সুবিধা ভোগী আমলাদের শীর্ষ একজন বদরে মুনীর ফেরদাউসের কুটচালের কাছে হেরে যাচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ১০ ব্যাংকের এমডির মধ্য একমাত্র অগ্রণী ব্যাংক ছাড়া বাকি ৯ ব্যাংকের নিয়োগ পেয়েছে বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের আশির্বাদে নিয়োগ পাওয়া সুবিধাবাদী ব্যাংকাররা। যাদের নিয়োগ দিয়ে শত কোটি টাকার উপরে সুবিধা নেয়ার অভিযোগ, আওয়ামী আমলে ডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালণকারী বদরে মুনীর ফেরদাউস দম্পত্তি।
অভিযোগ আছে, বদরে মুনীর ও টাকার কারিশমায় জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং বর্তমানে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা শওকত আলী খান রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় ব্যাংক সোনালীর এমডি হিসেবে নিয়োগ বাগিয়েছেন।
অভিযোগ বলছে, জনতার এমডি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক এজিএস মজিবর রহমান। যার ছোট ৩ ভাইয়ের নাম জামাল, কামাল, রাসেল, একমাত্র বোনের নাম হাসিনা। কতটা আওয়ামি সুবিধা ভোগী হইলে পুরো পরিবারের নাম মজিবর রহমানের নামের সাথে মিল থাকে? কথিত আছে এখানেও লেনদেন করেছে বদরে মুনীর ৩০ কোটি টাকা। রুপালী ব্যাংকের ৯৮ ব্যাচের আরেক কর্মকর্তা আব্দুর রহিমকে নিয়োগ দিয়ে ছিলো রুপালী ব্যাংকের এমডি হিসেবে। যে বিগত সরকারকে তোয়াজে নিয়মিত লিখতো কবিতা, পরে অবশ্য তার নিয়োগের টাকা হজম করতে পারেন নাই বদরে মুনীর।
বাকি ৬ জনও আওয়ামী আমলের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী যারা নিয়োগ পেয়েছেন টাকার জোরে । সাংবাদিক জুলকারনায়েন সামী’র পোষ্ট থেকে বদরে মুনীরের আমলনামার পোষ্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো:
“জনাব বদরে মুনীর ফেরদৌস, অতিরিক্ত সচিব, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, অর্থ মন্ত্রণালয়। আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৪-২০১৭ সাল পর্যন্ত নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক ছিলেন। শুধু তিনি নন, তার সহধর্মিণী সাবিনা আলমও আওয়ামী লীগের শাসনামলে হবিগঞ্জের ডিসি ছিলেন। আওয়ামী রেজিমের কতটুকু আশীর্বাদ থাকলে স্বামী-স্ত্রী দু'জনেই ডিসি হতে পারেন, তা সহজেই অনুমেয়।”
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক থাকা অবস্থায় এই কর্মকর্তা দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মচারীদের সাথে যোগসাজশে খাস জমি বন্দোবস্তসহ বিভিন্নভাবে কামিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। আর্থিক দুর্নীতির বিষয় নিয়ে গোয়েন্দা রিপোর্ট থাকায়, তিনি যথাসময়ে যুগ্মসচিব হতে পারেননি। হাজারো ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর নিজেকে বঞ্চিত দেখিয়ে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি বাগিয়ে নেন তিনি। শুধু তাই নয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে অতিরিক্ত সচিব হওয়ার কারণে সম্প্রতি বিভিন্ন ব্যাংকের এমডির পদায়ন-পদোন্নতির ক্ষেত্রে বাণিজ্য করে কামিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা।
এসব ব্যাংকের এমডি পদে পুনর্বাসন করেছেন আওয়ামী লীগের তোষামদকারী কর্মকর্তাদের। সোনালী ব্যাংকের নতুন এমডি টাঙ্গাইল আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা। রূপালীর নতুন এমডির নিয়োগ আটকে গেছে মুজিব আর হাসিনাকে নিয়ে কবিতা লিখে বই ছাপানোর কারণে।
তালিকায় রয়েছে সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান, ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তাদের আমলনামার পুরোটায় পূর্ণ ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগি হিসেবে।
খুনি হাসিনার শাসনামলে নির্বাচনের সম্পূর্ণ মেকানিজম সম্পন্ন করেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের অতিরিক্ত সচিব তার 'অনুগত অনুসারী' ‘বদরে মুনির ফেরদৌস ও ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’এর এজেন্টখ্যাত যুগ্ম সচিব মিণাক্ষী বর্মন’। সরকার বদলেছে তারপরও আর্থিকখাতকে ধ্বংসের পায়তারায় আজো সক্রিয় বদরে মুনির।
খাত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বদরে মুনির ফেরদৌস হাজারো শহীদের আত্মত্যাগকে অপমান করে চলেছেন। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে বদরে মুনির ফেরদৌস, মিনাক্ষী বর্মণরা। অবিলম্বে এদের বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে, তারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠবে এবং আওয়ামী চাটুকারদের পুনর্বাসন চলতেই থাকবে ব্যাংকিং খাতে।
রাষ্ট্রায়ত্ত্ব চার বানিজ্যক ব্যাংকে সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত এমডিদের আমলনামা: সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) শওকত আলী খান ১৯৯৮ ব্যাচের সিনিয়র অফিসার। ২০০৯ সাল পর্যন্ত ছিলেন সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার, ২০১০ ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা জনতার মঞ্চের কারিগর এম ফরিদ উদ্দিন, রুপালী ব্যাংকে এমডি হিসেবে যোগদান করলে, তার লুটপাটের প্রধান সহযোগী হয়ে উঠেন সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত সোনালী ব্যাংকের এমডি শওকত আলী খান । রুপালী ব্যাংক স্থানীয় কার্যালয় শাখায় ৬ বছর ঋণ বিভাগে কাজ করে ডিজিএম হিসেবে পদোন্নতি বাগিয়ে নেয় তিনি।
ওই সময় ইউনাইটেড এয়ার'র শাহীন নাম এক ব্যবসায়ীর ১৮ জন কর্মচারীর নামে ফরিদ উদ্দীনের ক্ষমতায় ৫ কোটি করে সিসি লোন হিসেবে মোট ৯০ কোটি টাকা লোপাট করেছে শওকত আলী খান । যার হদিস এখনো পাওয়া যায়নি। তাছাড়া তার বিরুদ্ধে সাড়ে ৪ হাজার কোটি ঋণ অনিয়মে জড়িত থাকার বিষয়টি রুপারী ব্যাংকের অভ্যন্তরীন নিরীক্ষা এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন উঠে এসেছে।
মজিবর রহমান জনতা ব্যাংকের সদ্য নিয়োগ প্রাপ্ত এমডি। তিনিও রুপালী ব্যাংকের ১৯৯৮ ব্যাচের কর্মকর্তা। ফরিদ উদ্দিনের সাথে সুসম্পর্ক না থাকলেও পরবর্তী এমডি আতাউর রহমান প্রধানের নজর কাড়েন তিনি। মজিবর রহমান রংপুরে জিএম হিসেবে থাকাকলীন সময়ে আতাউর প্রধান তাকে ঢাকায় বদলী করে আনেন। তার মাধ্যমে থার্মেক্স গ্রুপ, ডলি গ্রুপ, মাদার টেক্সটাইল, এস আলম গ্রুপ, নোমান গ্রুপসহ অন্তত ৩০টি গ্রুপকে প্রায় ৪ হাজার ৭০০ কোটি পাইয়ে দেয়ার লুটপাটের প্রধান কারিগর হিসেবে সহায়তা করেন বঙ্গবন্ধু পরিবারের সন্তান হিসেবে খ্যাত মজিবর। যার বদৌলতে আতাউর রহমান প্রধান তাকে (মজিবর) ডিএমডি এবং সোনালী থেকে অবসরের যাওয়ার আগে প্রবাসী কল্যান ব্যাংকের এমডি হিসেবে পদায়ন করতে সর্বোচ্চ সহায়তা করেছেন।
অভিযোগ আছে রুপালী ব্যাংকের ১৯৯৮ ব্যাচের অন্য কর্মকর্তা আব্দুর রহিম সারাজীবন কখনো ব্যাংকিং করেন নাই, এমন কি ঋণ আদায় এবং গ্রাহকদের নামে দুদকে অভিযোগ ছাড়া কোন কাজে করেন নাই। সব সময় নিজের পার্সোনাল ফাইল ফ্রেশ রেখেছেন। কবিতা লিখছেন আওয়ামী আমলা এবং নেতাদেরকে নিয়ে। কথিত আছে জীবনে কখনো ৫০ লক্ষ টাকার লোন ফাইলে স্বাক্ষর করেন নাই, বিধায় জিএম এবং ডিএমডি হিসেবে ০৬ ব্যাংকে ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি।
যদিও বিশ^স্ত গোয়েন্দা সূত্রের খবর, জামায়াতে ইসলামের পদাঙ্ক অনুসারী হিসেবে ড. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ তাহের সুপারিশ করেছেন তার জন্যে, তবুও তার নিয়োগ এখনো মন্ত্রণালয়ে ফাইলবন্দী হিসেবে ঝুলে আছে।
বৃহৎ রাষ্ট্রায়াত্ত্ব বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মধ্যে একমাত্র অগ্রণী ব্যাংকের ১৯৮৮ ব্যাচের কর্মকর্তা আনোয়ারুল ইসলাম বিএনপি জামাত বিধায় তার ২ বার তার ডিএমডি প্রমোশন আটকে যায়। ১৯৯৮ ব্যাচের ডিএমডি ওয়াহিদা বেগমের অধীনেও কাজ করতে হয়েছে আনোয়ারুল ইসলামকে। যদি ও তার নামে শ্যালকের মাধ্যমে ঋণের টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগটি এখনো তদন্ত করছে দুদক। তবে তিনি গ্রাহক বান্ধব এবং কর্মকর্তা বান্ধব হিসেবে ফিরবেন বলে আশা করছেন অগ্রণী ব্যাংকের অনেক কর্মকর্তা ও গ্রাহকরা।
অভিযোগের বিষয়ে মুঠোফোনে ফোন দেয়া হলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ), বদরে মুনীর ফেরদৌস জানান, ‘পুরো প্রক্রিয়ায় কমিটি সংশ্লিষ্ট। যেটা গোয়েন্দা সংস্থার পাঠানো রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে করা হয়। পরে অর্থ উপদেষ্টার সুপারিশে খোদ মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ নিশ্চিত করেছেন। যাতে আমার হস্তক্ষেপের সুযোগ নেই। ’এবিষয়ে তিনি আরো বলেন,‘এসব নিয়োগের ক্ষেত্রে তার সাথে কোন ধরণের আর্থিক সুবিধা আদায়ে প্রমাণ মিলবে না।’
এবিষয়ে সোনালী ব্যাংকের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপণা পরিচালক, শওকত আলী খান জানান তিনি ছাত্র জীবনে কোন রাজনৈতিক দলের অনুসারী বা সদস্যও ছিলেন না। বর্তমান যিনি টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা তার নাম শওকত আলী সিকদার, তিনি জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা নন। যার সত্যতা গোয়েন্দা প্রতিবেদনে রয়েছে। এই তালিকার আরেক অভিযুক্ত এমডি মজিবুর রহমানের বক্তব্য জানতে মুঠোফোনে ফোন দেয়া হলে যুক্ত হওয়া যায়নি।
আ. দৈনিক /কাশেম/ এমআই