বাংলাদেশ জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, আপোষহীন সাংবাদিক নেতা রুহুল আমিন গাজী ভাইকে হারিয়ে একটি শূন্যতা অনুভব করছি। আমি খুলনা প্রেসক্লাবের সদস্য ছিলাম। তখন থেকেই গাজী ভাইকে চিনি। তার মত এমন সৎ সাহসী নেতৃত্ব বিরল। তার মধ্যে কোনো মৃত্যুভয় ছিল না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি মরহুম রুহুল আমিন গাজীর মধ্যে কোনো ভীরুতা ছিল না। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী বিরোধী আন্দোলনসহ সাংবাদিকদের পেশাবিরোধী সব কালাকানুনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন তিনি। এজন্য তাকে ১৮ মাস কারাগারে নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তাকে ডিভিশন দেয়া হয়নি। তার পরিবারকে মানসিক নির্যাতন করা হয়েছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, বিদেশী ষড়যন্ত্রে সর্বত্র অনৈক্য দেখা দিয়েছে। কিন্তু জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় ঐক্যের বিকল্প নেই। জাতির বিবেক সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য দরকার। জাতীয় পর্যায়ে ঐক্য দরকার। কী কারণে অনৈক্য হয়, সেটিও খুঁজে বের করে প্রতিকার করতে হবে।
আজ মঙ্গলবার (০১ অক্টোবর) জাতীয় প্রেসক্লাব মিলনায়তনে বিএফইউজে ও ডিইউজে আয়োজিত নাগরিক শোক সভায় রাজনৈতিক ও সাংবাদিক নেতারা এ কথা বলেন।বক্তারা বলেন, দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব যখনই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তখনই সাংবাদিক গাজী বুক চিতিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। সর্বশেষ ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় অসুস্থ থাকার পরও রাজপথে নেমে আমাদের সাহস জুগিয়েছেন তিনি। তার মৃত্যু সাংবাদিক জগতে একটি শূণ্যতা সৃষ্টি হয়েছে।
বক্তারা অভিযোগ করে বলেন, সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ এই নেতার একটি কিডনি কেটে ফেলতে হয়েছিল। এরপরও তাকে গ্রেফতার করে ১৮ মাস জেলে রাখা হয়। সেখানে তাকে উপযুক্ত চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হয়নি। চিকিৎসায় অবহেলা করে তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এজন্য ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকার এবং ওই সময় দায়িত্বপালন করা কারাগারের জেলার ও চিকিৎসকের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা উচিৎ। তাদের গ্রেফতার করে বিচার করতে হবে।
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন-ডিইউজের সভাপতি মো: শহিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল ও সাবেক এমপি অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল এবং ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও সাবেক সাংবাদিক নেতা ড. আব্দুল মান্নান।
আরো বক্তৃতা করেন বিএফইউজের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী, সাবেক মহাসচিব এম এ আজিজ, ডিইউজের সাবেক সভাপতি এলাহী নেওয়াজ খান সাজু, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি কামাল উদ্দিন সবুজ, বর্তমান সভাপতি কবি হাসান হাফিজ, নিউ নেশনের সাবেক সম্পাদক মোস্তফা কামাল মজুমদার, ডিইউজের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বাকের হোসাইন ও সরদার ফরিদ আহমদ, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ ও ইলিয়াস খান, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাবেক সভাপতি মুরসালিন নোমানী, বিএফইউজের সহ-সভাপতি খায়রুল বাশার ও এ কে এম মহসিন, সাংগঠনিক সম্পাদক এরফানুল হক নাহিদ, প্রচার সম্পাদক সাজাহান সাজু, ডিইউজের সহ-সভাপতি কবি রফিক মুহাম্মদ ও রাশেদুল হক, আমার দেশের বার্তা সম্পাদক জাহেদ চৌধুরী, চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শাহনেওয়াজ, ফেনী সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি সিদ্দিক আল মামুন, মুন্সিগঞ্জ সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি জসিম উদ্দিন প্রমুখ।
শোক সভায় মরহুম সাংবাদিক রুহুল আমিন গাজীর একমাত্র ছেলে আফফান আবরার আমিন বাবার স্মৃতিচারণ করেন।
সভা সঞ্চালনা করেন ডিইউজের সাধারণ সম্পাদক খুরশিদ আলম, বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব বাছির জামাল, ডিইউজের যুগ্ম সম্পাদক দিদারুল আলম দিদার ও ডিইউজের কোষাধ্যক্ষ খন্দকার আলমগীর হোসেন।
ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, রুহুল আমিন গাজী ভাই নেই, বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই তাকে চিনি। তিনি ছিলেন একজন অসীম সাহসী নেতা। প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। সর্বশেষ ৫ আগস্ট ফ্যাসিবাদী আওয়ামী সরকারের পতনের আগের দিনও তিনি অসুস্থ অবস্থায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পেশাজীবীদের আন্দোলনে রাজপথে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৫ আগস্টও তিনি প্রেসক্লাবের বসে আন্দোলনে পেশাজীবীদের কর্মকাণ্ড মনিটরিং করছিলেন। এভাবে সব সময়ই সাংবাদিক, পেশাজীবীসহ দেশের গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার যেকোনো আন্দোলনে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন তিনি।
বিএনপির এই নেতা বলেন, গাজী ভাইয়ের একটি কিডনি কেটে ফেলতে হয়েছিল। এ রকম রোগীকে নিয়মিত চিকিৎসা দিতে হয়। কিন্তু তাকে জেলে নিয়ে চিকিৎসার সুযোগ দেয়া হয়নি। তাকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তিনি মূলত একজন শহীদ। তার আত্মত্যাগ আমাদের মনে রাখতে হবে। একইসাথে কারাগারের যে জেলার ও ডাক্তার তার চিকিৎসা দেয়নি তাদের বিচার করতে হবে। তিনি অবিলম্বে আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের মুক্তি দাবি করেন।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আব্দুস সালাম বলেন, রুহুল আমিন গাজী সাংবাদিক জগতের একটি ঐক্যের নাম ছিলেন। তিনি গণতন্ত্রের মুক্তি ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি আজ নেই। কিন্তু নতুন যে সরকার রয়েছে সেখানে ফ্যাসিবাদের দোসররা রয়ে গেছে। অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরদের পাশে বসিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। তাদের মনে রাখতে হবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে তারা এখানে বসার সুযোগ পেয়েছে। তারা ভুল করলে হাসিনার মত তাদেরও পরিণতি একই রকম হবে।
তিনি আরো বলেন, ‘৯৬ সালে অনৈক্য থাকায় আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার সুযোগ পেয়েছিল। এখন আবার একই রকম অনৈক্য দেখা দিয়েছে। এতে আবারো ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ চলে আসতে পারে। সেজন্য তারেক রহমান বলেছেন ‘আমাদের ঐক্য গড়ে তুলতে হবে’।
জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান বলেন, রুহুল আমিন গাজী সব সময় অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ছিলেন। তিনি কখনো অন্যায়ের সাথে আপস করেননি। সাহসের বাতিঘর ছিলেন তিনি।ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে যারা মামলার শিকার হয়েছেন তাদের মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে জানিয়ে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের চারপাশে ১/১১ এর কুশিলবরা অবস্থান করছে।
বর্তমান সরকারকে উদ্দেশ করে তিনি আরো বলেন, ছাত্র-জনতা দেখিয়েছে কাদের কোথায় বসাতে হবে। সেজন্য আপনারাও সাবধান হয়ে যান। ফ্যাসিবাদীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করুন। না হলে আবারো রাজপথে নামতে বাধ্য হবো।
অবিলম্বে আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানকে মুক্তি দেয়ার দাবি জানান রফিকুল ইসলাম খান।জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ফ্যাসিবাদের সময়ে যখন রাজনৈতিক নেতারা কথা বলতে পারেনি, তখন রহুল আমিন গাজী ভাই ঝুঁকি নিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে অবস্থান নিয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে বলিষ্টভাবে কথা বলেছেন। একইভাবে তিনি সাংবাদিকদের অধিকার আদায়ে সাহসী ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি আমাদের অহংকার। ফ্যাসিবাদমুক্ত নতুন বাংলাদেশকে সঠিক পথে রাখতে গাজী ভাইয়ের মত আপসীন নেতার বড় প্রয়োজন ছিল।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিদায় নিয়েছে, কিন্তু রাষ্ট্রের সকল স্তরে এখনো ফ্যাসিবাদী শক্তি বসে রয়েছে। অন্তর্বতী সরকার যদি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয় তাহলে জাতি তাদের ক্ষমা করবে না।
নুরুল ইসলাম বুলবুল বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যের প্রয়োজন। কিন্তু বাধা কোথায় কোথায় সেটি আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। এজন্য আগে আমাদের সবার মানসিকতার পরিবর্তন করতে হবে।ওবায়দুর রহমান শাহিন বলেন, চিকিৎসা করতে না দিয়ে রুহুল আমিন গাজী ভাইকে হত্যা করা হয়েছে। তার পরিবার যদি কোনো হত্যা মামলা করে তাহলে বিএফইউজে সহযোগিতা করবে।
কাদের গণি চৌধুরী বলেন, রুহুল আমিন গাজী দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে সাংবাদিকদের নেতৃত্ব দিয়েছেন। শুধু এটিই নয়, তিনি গণতন্ত্র রক্ষা ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। একটি দিনের জন্যও তিনি বিরতি দেননি।
তিনি বলেন, বর্তমান মুক্ত বাংলাদেশে মাহমুদুর রহমান জেলে কেন? তাকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। না হলে আমরা আবারো রাজপথে নামতে বাধ্য হবো।জাতীয় প্রেস ক্লাব সভাপতি কবি হাসান হাফিজ বলেন, তাকে নিয়ে একটি স্মারক গ্রন্থ প্রকাশ করা যেতে পারে। তাহলে পরবর্তী প্রজন্ম তার সম্পর্কে জানতে পারবে। তার মত আপসহীন লড়াকু নেতৃত্বের ইতিহাস ধরে রাখতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে শহিদুল ইসলাম বলেন, রুহুল আমিন গাজীর সিনা যত বড় ছিল, কলিজা ছিল তার চেয়ে অনেক বড়। তিনি আন্দোলন সংগ্রামে একজন সাহসী নেতা ছিলেন। যেকোনো কর্মসূচিতে তাকে ডাকলেই চলে আসতেন। রুটি-রুজির আন্দোলনে তার সমকক্ষ কোনো নেতা ছিল বলে আমার জানা নেই। তিনি কর্ম, সাহস ও ডেডিকেশন দিয়েই নেতা হয়েছিলেন। আন্দোলন সংগ্রামে তিনি ছিলেন আমাদের বটগাছ। তার শূন্যতা আমরা পূরণ করতে পারবো কিনা জানি না।
রুহুল আমিন গাজীর ছেলে আফফান আবরার আমিন বলেন, আমার বাবাকে যেভাবে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়েছে তাতে আমি সবার প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি খুবই দেশপ্রেমিক ছিলেন। সব সময় দেশের মানুষের কথা ভাবতেন। আমার বাবা জীবনের শেষ সময়ে আমাকে বলে গেছেন, তিনি একটি বৈষম্যহীন, চাঁদাবাজ-দুর্নীতিমুক্ত মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র দেখতে চান। আশা করি সাংবাদিক সমাজ সেটি বাস্তবায়নে ভূমিকা রাখবেন। তাহলেই আমার বাবার রূহে শান্তি পাবে।
আ. দৈ. /কাশেম